আহনাফ বিন কায়েস

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আহনাফ বিন কায়েস ছিলেন একজন আরব সর্দার ও বীর যোদ্ধা। তাঁর সাহস ও বীরত্ব ছিল অপরিসীম। ইসলাম গ্রহণ করার পর আল্লাহর নবী (সা:)-কে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। তবে নবীর বহু সাথীকেই তিনি দেখেছেন।
একদিন তার সামনে এক ব্যক্তি কুরআনের এই আয়াতটি পড়লেন,
‘‘লাকাদ আনঝালনা ইলাইকুম কিতাবান ফীহি যিকরুকুম। আফালা তাঅকিলূন।”
অর্থাৎ, “(হে মানুষ) আমি তোমাদের কাছে এমন একটি কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তোমাদের (সবার) কথা আছে, অথচ তোমরা চিন্তা ভাবনা কর না।” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০)
আহনাফ অভিভূত হয়ে গেলেন, কেউ বুঝি তাকে আজ নতুন কিছু শোনাল! মনে মনে বললেন, ‘‘ আমাদের কথা আছে! কই কুরআন নিয়ে আস তো? দেখি এতে আমার কথা কি আছে!” তার সামনে কুরআন শরীফ আনা হল। একে একে বিভিন্ন ধরনের লোকের পরিচিতি এতে পেশ করা হল।
একদল লোকের পরিচয় এভাবে পেশ করা হল- ‘‘এরা রাতের বেলায় খুব কম ঘুমায় এবং শেষ রাতে আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহখাতার জন্য মাগফেরাত কামনা করে।” সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৭-১৮)
আবার একদল লোক এল, যাদের সম্পর্কে বলা হল, ‘‘তাদের পিঠ রাতের বেলায় বিছানা থেকে আলাদা থাকে। তারা নিজেদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও প্রত্যাশা নিয়ে, তারা অকাতরে আমার দেয়া রিজিক থেকে খরচ করে।”
কুরআনের কিছু দূর এগিয়ে যেতেই তার পরিচয় হল আরেকদল লোকের সাথে। তাদের সম্পর্কে বলা হল, ‘‘তারা (তাদের) রাতগুলো কাটিয়ে দেয় নিজেদের মালিকের উদ্দেশ্যে সিজদা ও দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে।” (সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৪)
অত:পর এলো আরেক ধরনের মানুষ, এদের সর্ম্পকে বলা হল, ‘‘এরা দারিদ্র্য ও স্বাচ্ছন্দ উভয় অবস্থায় (আল্লাহর পথে ) অর্থ ব্যয় করে, এরা রাগকে নিয়ন্ত্রন করে, এরা মানুষদের ক্ষমা করে। বস্তুতঃ আল্লাহ এসব নেককার লোকদের দারুণ ভালবাসেন।” ( সূরা আল- ইমরান, আয়াত-১৩৪ )
এলো আরেকটি দল। তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হল, “এরা (বৈষয়িক প্রয়োজনের সময়) অন্যদেরকে নিজেদেরই উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের নিজেদের রয়েছে প্রচুর অভাব ও ক্ষুধার তাড়ণা। যারা নিজেদেরকে কার্পণ্য থেকে দূরে রাখতে পারে তারা বড়ই সফলকাম।” (সূরা হাশর, আয়াত ৯)
একে একে এদের সবার কথা ভাবছেন আহনাফ। এবার কুরআন তার সামনে আরেকদল লোকের কথা পেশ করল- ‘‘এরা বড় বড় গুনাহ এবং অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে, যখন এরা রাগান্বিত হয় তখন (অন্যের ভুল) ক্ষমা করে দেয়, এরা আল্লাহর হুকুম আহকাম মেনে চলে, এরা নামাযের প্রতিষ্ঠা করে, এরা নিজেদের মধ্যকার কাজকর্মগুলোকে পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদন করে। আমি তাদের যে রিজিক দান করেছি তা থেকে তারা অকাতরে ব্যয় করে।” (সূরা আশ শূরা- আয়াত ৩৭-৩৮)
হযরত আহনাফ নিজেকে নিজে জানতেন। আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত এসব লোকদের কথাবার্তা শুনে তিনি বললেন, ” হে আল্লাহপাক! আমি তো এই কিতাবের কোথাও আমাকে খুঁজে পেলাম না। আমার কথা কই? অথচ এ কিতাবে নাকি তুমি সবার কথাই বলেছ ?”
এবার তিনি ভিন্ন পথ ধরে কুরআনে নিজের ছবি খুঁজতে লাগলেন। এ পথেও তাঁর সাথে বিভিন্ন দল-উপদলের সাক্ষাৎ হল। প্রথমে তিনি পেলেন এমন একটি দল, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,
‘‘ যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তথন তারা গর্ব ও অহঙ্কার করে এবং বলে, আমরা কি একটি পাগল ও কবিয়ালের কথায় আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করব ?” (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ৩৫-৩৬)
তিনি আরও দেখলেন, কতিপয় হতভাগ্য লোককে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, ‘‘তোমাদের কিসে জাহান্নামের এই আগুনে নিক্ষেপ করল? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের দলে শামিল ছিলাম না, ক্ষুধার্ত ও অভাবী ব্যক্তিদের আমরা খাবার দিতাম না, যারা অন্যায় ও অমূলক আলোচনায় উদ্যত হত, আমরা তাদের সাথে মিলে (অর্থহীন) কথাবার্তা বলতাম। ‘‘ (সূরা আল-মুদ্দাস্সির, আয়াত ৪২-৪৫)
হযরত আহনাফ নিজেকে নিজে ভালভাবেই চিনতেন। তিনি কোন অবস্থায়ই নিজেকে এই শেষের লোকদের দলে শামিল বলে ধরে নিতে পারলেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি নিজেকে প্রথম শ্রেণীর লোকদের কাতারেও শামিল করতে পারলেন না। তার মনে নিজের ঈমানের যেমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তেমনি নিজের গুনাহ খাতার স্বীকৃতিও সেখানে সমানভাবে মজুদ ছিল। কুরআনের পাতায় তিনি এমনি একটি ভাল-মন্দ মিশান মানুষের ছঁবিই খুঁজছিলেন এবং তাঁর একান্ত বিশ্বাস ছিল এমনি একটি মানুষের ছবি অবশ্যই তিনি এই জীবন্ত পুস্তকের কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবেন।
কুরআনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় সত্যিই হযরত আহনাফ নিজেকে খুঁজে পেলেন। খুশিতে তার মন ভরে উঠল। সাথে সাথেই বলে উঠলেন, হ্যা এই তো আমি!
আয়াতটি ছিল সূরা তওবার ১০২ নং আয়াত। আল্লাহপাক বলছেন,
‘‘ (তোমাদের মাঝে) এমন কিছু লোক আছে, যারা (অকপটে) নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে। এরা ভালমন্দ মিশিয়ে কাজকর্ম করে, কিছু ভাল, কিছু মন্দ। আশা করা যায়, আল্লাহতায়ালা এদের ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তাঁর মাগফেরাত লাভের তৌফিক দিন। আমীন।

Comments